সম্পাদকীয় :
২৬ মার্চ, ২০২৪তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ইতিহাসের এই দিন বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহংকার দৃপ্ত শপথের দিন আজ। ভয়াল ‘কালরাত্রি’র পোড়া কাঠ, লাশ আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখল লাশপোড়া ভোর। সারিসারি স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কুন্ডলি পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। পুড়ছে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সবুজ পতাকা। জ্বলছে শাড়ি, খুকুর ফ্রক। চোখে জল। বুকে আগুন। জ্বলে উঠল মুক্তিকামী মানুষের চোখ, গড়ল প্রতিরোধ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ‘জয় বাংলা’ তীব্র স্লোগান তুলে ট্যাংকের সামনে এগিয়ে দিল সাহসী বুক।
বিশদ বিবরণঃ বাংলাদেশের যেমন একটি গর্বিত লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা আছে, তেমনি আছে বেশ কয়েকটি জাতীয় দিবসও। আবার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় সংগীত, শহীদ মিনার; এমনকি জাতীয় ফুল, ফল, পশু, পাখি, মাছ এবং জাতীয় বন—এসবও আছে।
আমাদের গৌরবময় ও স্মৃতিবিজড়িত জাতীয় দিবসগুলো হচ্ছে: ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশুদিবস ও ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের দিন জাতীয় শোকদিবস। বন্ধুরা, আমরা আজ ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কিছু কথা বলব। বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির নেতা। তিনি আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির পিতা। অথচ ভিন্ন আদর্শের অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে তাঁর জন্মদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হবে না বা কোন দিবস পালিত হবে না বঙ্গবন্ধুর নামে তা কি ভাবা যায়? আমাদের এই ক্ষুদ্রমনের নেতারা ভুলে যান— বঙ্গবন্ধু ছাড়া এই দেশ স্বাধীন হতো না; তারাও কখনো প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী কিংবা হোমরাচোমরা নেতা হতে পারতেন না।
বাঙালির জীবনে নানা কারণে মার্চ মাস শক্তি ও প্রেরণার উৎস। মুক্তিসংগ্রামের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এ মাস থেকেই। উনিশ শ’ একাত্তর সালের এই মাসে তীব্র আন্দোলনের পরিণতিতে শুরু হয় মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলেও চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই। এ মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে হাজারো মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
ক্ষুব্ধ ছাত্ররা প্রথমবারের মতো স্লোগান দেয়, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচী ঘোষণার দাবি জানায়। বিক্ষোভ- স্লোগানে উত্তাল ঢাকাসহ সারাদেশ। আর কোন আলোচনা নয়, এবার পাক হানাদারদের সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি ক্রমশ বেগবান হতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন। সেই শুরু -এরপর ১ মার্চ পেরিয়ে ২ মার্চ। একে একে পার হয় বাঁধাবিক্ষুব্ধ ২৫টি দিন। চলে আক্রমণ, প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে পাল্টা জবাব দেয় বীর যোদ্ধারা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ চালায়, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
এই পথ ধরে বাঙালি দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনেন একটি স্বাধীন দেশ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ সাবেক রেসর্কোস ময়দান- আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া এই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় মুহুর্মুহু গর্জনে উত্তাল ছিল জনসমুদ্র। লাখ কণ্ঠের একই আওয়াজ উচ্চারতি হতে থাকে দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ঢাকাসহ গোটা দেশে পত পত করে উড়ছিল সবুজ জমিনের উপর লাল সবুজের পতাকা।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা প্যারিসের ইউনেস্কোর সদর দফতরে এই স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকা সংরক্ষণ করে থাকে। মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারের অন্তর্ভুক্ত প্রামাণ্য ঐতিহ্যের তালিকা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে গুরুত্ববহ।
ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারের লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এবং বিশ্ববাসী যাতে ঐতিহ্য সম্পর্কে সহজে জানতে পারে তা নিশ্চিত করা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠছিল- সে আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সর্বত্র। এর পরে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের মার্চ বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন বার্তা। এ বছরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এর আগে ২৫ মার্চ রাত একটার পরে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী সেনারা গ্রেফতার করে তার বাড়ি থেকে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানীরা বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে অপারেশন সার্চলাইট নামে বাঙালি নিধনে নামে। ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে সেনারা নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ছাত্রী-শিক্ষককে হত্যা করে। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ প্রতিরোধের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা হয়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যোগদেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে জাতি লাভ করে স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের এক মহান মানুষ। সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদকে তিনি সব সময় ঘৃণা করতেন। অন্যায়-অবিচার, জেল-জুলুম-নির্যাতনের কাছে তিনি কোনোদিন মাথা নত করেননি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন: আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। এই বাংলাদেশকে তিনি বড্ড ভালোবাসতেন।
শেষ কথাঃ আমরাও বঙ্গবন্ধুর মতো দেশকে ভালোবাসব। উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে উঠব। স্বাধীনতার শত্রুদের সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আমরা এ দেশকে গড়ে তুলব—এবারের ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এ-ই হোক আমাদের দৃপ্ত শপথ।