নিজস্ব প্রতিবেদক : গাজীপুরের কালীগঞ্জে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, সাবেক দুই উপজেলা চেয়ারম্যান, কালীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র, গাজীপুর জেলা পরিষদের সদস্য ও দায়িত্বরত চারজন ইউপি চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১১৪ নেতা-কর্মীর নামে হত্যা, মারধর ও চুরির অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। বুধবার (২১ আগষ্ট) তিন ঘন্টার ব্যবধানে মামলা তিনিটি নথিভুক্ত করেন কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহাতাব উদ্দিন। পুলিশ ও প্রথম মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট বেলা ১১ টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশ নেয়া উত্তরগাঁও এলাকার কিসমিস আলীর ছেলে ইসমাইল হোসেনসহ বিএনপির নেতাকর্মীরা বালীগাঁও বাইপাস সড়কে মিছিল করার সময় মেহের আফরোজ চুমকির হুকুমে অন্য আসামিরা তাকে মারধর করে গুরুতর জখম করেছে। এ ঘটনায় ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে ২১ আগস্ট রাতে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিসহ আওয়ামী লীগের ৬৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে বেআইনি জনতাবদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রসহ হত্যার উদ্দেশ্যে হুকুম প্রদান, মারধর, গুরুতর জখম ও হুমকির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামির মধ্যে রয়েছে, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন পলাশ, সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন স্বপন, আওয়ামী লীগ নেতা মাজেদুল ইসলাম সেলিম, জেলা পরিষদের সদস্য দেলোয়ার হোসেন, সাবেক সদস্য সফিকুল কাদের নান্নু, বাহাদুরসাদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আহমেদ, জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খাইরুল আলম, সাবেক চেয়ারম্যান নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলিউল ইসলাম অলি, সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজ মোড়ল, কালবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফ মিয়া, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আহমেদুল কবির, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম, কাউন্সিলর আমির হোসেন খাঁ, আশরাফুল আলম রিপন, বাদল হোসেন, তুমুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন। অন্যরা সকালেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।
দ্বিতীয় মামলাসূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান শেখ বাবলু বাদী হয়ে ২১ আগস্ট দিবাগত রাতে মেহের আফরোজ চুমকিসহ আওয়ামী লীগের ৪০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বেআইনি জনতাবদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রসহ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হুকুম দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট, সাধারণ ও গুরুতর জখম করে হত্যা ও লাশ গুমের পরিকল্পনার দায়ে মামলা দায়ের করেছেন।
এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ৬ মে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা যুবদলের সম্মেলনে যাওয়ার সময় মেহের আফরোজ চুমকির নির্দেশে ও হুকুমে অন্য আসামিরা বিএনপি নেতা কর্মীদের বাঁধা দিতে মারধর করে। সে সময় বিকল্প পথ হিসেবে শীতলক্ষ্যা নদীপথে ট্রলারে করে সম্মেলনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দুপুর ২ টার দিকে কালীগঞ্জ খেয়া ঘাট এলাকায় পৌঁছালে আসামিরা বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নেতাকর্মীদের ট্রলারের গতিরোধ করে আক্রমণ করে। সে সময় ট্রলারে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়। এরমধ্যে একজন যুবদল কর্মী চৈতারপাড়া এলাকার আনোয়ার হোসেনের ছেলে জামির হোসেনকে (৪০) হত্যার উদ্দেশ্যে যুবলীগ নেতা মাইনুল তার হাতে থাকা লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে মারাত্মক গুরুতর জখম করে পরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে অন্য আসামিরা ট্রলার থেকে জামির হোসেনকে নদীতে ফেলে দেয়। এছাড়াও যুবদলের আরেক কর্মী পলাশ উপজেলার ফিরিন্দা টেকপাড়া এলাকার আঃ আব্দুস সালামের ছেলে নাঈম হোসেনকে (২০) হত্যার উদ্দেশ্যে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে সহিদুল ইসলাম ভুট্টো এবং অন্য আসামিরা নাঈমের মৃত্যু নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্রলার থেকে তাকেও নদীর পানিতে ফেলে দেয় এবং অন্য আসামিদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়া ট্রলারে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে কুপিয়ে প্রায় ৩৫-৪০ জন নেতাকর্মীকে মারাত্মক জখম করে এবং সম্মেলনে যাওয়া বাধাগ্রস্ত করে। আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। উক্ত ভিকটিমরা তথা জমির ও নাঈমের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর কালীগঞ্জ খেয়া ঘাটের দক্ষিণ পাশ থেকে ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২০১১ সালের ৭ মে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার করে। সে সময় আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনার বিষয়ে কালীগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে আসামিদের বাঁধার কারণে তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অভিযোগ গ্রহণ করেননি। যার কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
এ মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছে, কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র এস এম রবীন হোসন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম আবু বক্কর চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মাজেদুল ইসলাম সেলিম, আওয়ামী লীগ নেতা মাইনুল ইসলাম ও, সহিদুল ইসলাম ভুট্টো, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আহমেদুল কবির আবু খান সাধারণ, পৌর আওয়ামী লীগের সম্পাদক কামরুল ইসলাম, জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সারোয়ার হোসেন গাজী, মোক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম তোরণ, জামালপুরের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান খান ফারুক মাস্টার, বক্তারপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান পলাশ, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ টিপু, পৌর যুবলীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর বাদল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আশরাফি রেজাউল রহমান খোকন, বাহাদুরসাদী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাবেক সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা অমিত, আলভি, লিখন। অন্য আসামিরা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী।
উল্লেখ্য: উক্ত ঘটনায় ২০১১ সালের ৮ মে প্রথমে একটি অপমৃত্যু মামলা হয় { নং ১৪/২০১১}। এরপর ৯ মে ১৬ জনের বিরুদ্ধে যুবদল নেতা ঘোনাপাড়া এলাকার মৃত হাসিব উদ্দিনের ছেলে নাদিম আহমেদ বাদী হয়ে যুবলীগ নেতা মাইনুল ইসলামসহ ১৬ জনের নামে গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা (৯৫/২০১১) দায়েরের জন্য আবেদন করেন। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে ৫ জুন মামলাটি নথিভুক্ত করে কালীগঞ্জ থানা পুলিশ {মামলা নাম্বার ৩(৬)২০১১}। এরপর দীর্ঘদিন থানা পুলিশের চার জন তদন্ত কর্মকর্তা এবং পরবর্তীতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের চারজন তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকল আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য (নং-১৩) দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান। এরপর আদালত ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি পূণরায় তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে প্রায় সাত মাস তদন্ত কার্যক্রম করে ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পিবিআইও গোয়েন্দা পুলিশের মত সকল আসামির অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (সত্য -৫৭) দাখিল করেছেন।
তৃতীয় মামলা
তৃতীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে ২১ আগষ্ট ২ টা ৪৫ মিনিটে , {মামলা নাম্বার ৬(৮)২৪}।
এ মামলার বাদী হলেন কালীগঞ্জ উপজেলার বাদীগাঁও এলাকার মৃত আব্দুল আওয়ালের ছেলে শরিফ মিয়া । অস্ত্রশস্ত্রসহ পথরোধ করে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, গুরুতর জখম, রক্তাক্ত ও হুমকি দেয়ার দায়ে স্থানীয় যুবলীগের সভাপতি ও কাউন্সিলর বাদল হোসেন, তার ভাই এনামুল হক মনু, আলম ভূঁইয়াসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের